ফিরে দেখা :: সাড়ে চুয়াত্তর


সিনেমা তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য বোধহয় দর্শককে আনন্দ দেওয়া । তাই দর্শক যেভাবে আনন্দ পায়, দর্শকদের কথা মাথাতে রেখে সিনেমা নির্মাতারা সিনেমা বানিয়ে আসছেন এতকাল । তাই সে দেবের “পাগলু” হোক, প্রসেনজিতের “মা” কিংবা চিরঞ্জিতের “বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না” – প্রত্যেকটা সিনেমাই সেই সময়ের হিট থেকে সুপারহিট । তবে কালের অতলে তলিয়ে যাবার মতন পঞ্চাশ বছর পরে এগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা । ক্রমাগত ভাবি, সাউন্ড-ভি এফ এক্স-ডাবিং বিহীন সাদাকালো একটি ছবিতে কি এমন মশলা রয়েছে, যাতে করে ৬০ বছর পরেও একটি সিনেমা দেখে দর্শক আনন্দ পায় ( আমি সাধারণ দর্শকদের পর্যায়ে পড়ি, ফেলেনি-গোদার-অ্যান্টনিঅনি যারা চর্চা করেন তাঁরা আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন ।) এত গৌরচন্দ্রিকা করলাম শুধুমাত্র নিজের বিস্ময় (সীমাহীন) প্রকাশ করবার জন্য । ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া “সাড়ে চুয়াত্তর” ছবিটির কথা বলছি । উত্তম-সুচিত্রার প্রথম একসাথে স্ক্রীনে আগমন এই ছবিটির হাত ধরেই । ছবিটিতে তারকার সমাবেশ – তুলসী চক্রবর্তী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, রেবা বোস, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, মলিনা দেবী, নবদ্বীপ হালদার, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দেবেন বন্দ্যোপাধ্যায়, পঞ্চানন ভট্টাচার্য – কে নেই !



ছবিটিতে দেখানো হয়, রজনীবাবু (তুলসী চক্রবর্তী)কলকাতার একটি মেসের (অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউস) মালিক । তাঁর মেসেই বেশ কিছু ছেলে ছোকরার বাস ( যেমনটা হয় আর কি) । মেসের মধ্যে সকলের নির্বাচিত নেতা হল রামপ্রীতি (উত্তম কুমার) । রজনীবাবুর এক দূরের সম্পর্কের আত্মীয় (গুরুদাস ব্যানার্জী) হঠাৎ একদিন তাঁর স্ত্রী(পদ্মাদেবী) ও মেয়ে রমলাকে (সুচিত্রা) সাথে নিয়ে মেসে চলে আসে আস্তানার খোঁজে । মেসে মিটিং হয়ে সিদ্ধান্ত হয় তাঁরা যতদিন না ঘর পাচ্ছেন মেসেই তাঁদের থাকার জায়গা করে দেওয়া হবে । তবে মেসের প্রবীণ বাসিন্দা যেমন অখিল বাবু বা শিববাবুদের একটু সমস্যা ছিল কারণ তাঁদের মতে এই মেসে ছেলে ছোকরাদের কারবার, একজন অবিবাহিতা মেয়ের জন্য (সুচিত্রা অরফে রমলা) মেসের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে । তবে প্রবীণদের এই মতামতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, তরুণ ব্রিগেড ঠিক করে ফেলে এই অসহায় পরিবারটিকে মেসে জায়গা দেওয়া হবে । তবে এই সব সিদ্ধান্ত রামপ্রীতির(উত্তম কুমার) অবর্তমানে ঠিক হয়।


বউ মানে কি ? বউ মানে গাছতলা 
প্রত্যেক উইকেন্ডে দেশের বাড়ি যাওয়ার বাঁধাধরা নিয়ম রজনীবাবুর । বিয়ের বহু বছর পরে তাঁর দাম্পত্যে নিমিত্ত ভাটাও পড়েছে । তাঁর স্ত্রী (মলিনা দেবী)তাঁর সাথে ভালো করে দুটো কথাও বলেন না । অন্যদিকে মলিনাদেবীর বিশ্বাস শহরে মেসে বেশ ফূর্তিতে রয়েছেন তাঁর স্বামী । রজনীবাবু নিদারুণ ভাবে মিস করেন তাঁদের যৌবনের স্মৃতি । যখন স্ত্রীরা তাঁদের স্বামীকে চিঠি পাঠাত, যে চিঠির খামে লেখা থাকত, সাড়ে চুয়াত্তর (অর্থাৎ গোপনীয়, যাকে চিঠি লেখা হয়েছে তিনি ব্যাতীত অন্য কেউ দেখতে পারবে না। বলা বাহুল্য, এই চিঠি প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেই কেবল আদান প্রদান হত !) যদিও মলিনাদেবী তাঁর স্বামীর যৌবনের নস্টালজিয়াকে বুড়ো বয়সের ভীমরুতি ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না ।
আপনি কিভাবে জানলেন আমাদের আজ মালপোয়া তৈরি হয়েছে ? 

রামপ্রীতির, মেসে টেলিফোন করে রাতের খাবারের কথা জানাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটে । সে যতবার মেসের নাম্বার ডায়াল করে ফোন  মেয়েরা (প্রথমবার রমলার মা এবং পরে রমলা নিজে) রিসিভ করে । কিন্তু রামপ্রীতি জানে তাঁদের মেসে কোনো মেয়ের বাস নেই । এই ভুলবোঝাবুঝি থেকে নায়ক-নায়িকার বাদানুবাদ এবং প্রথম আলাপ । এরপর ধীরে ধীরে প্রেম । তাঁদের( উত্তম ও সুচিত্রা) চিঠি একদিন চাকর মদনের(নবদ্বীপ হালদার) হাত ঘুরে মেসের অন্য সকলের কাছে পৌঁছে যায় । রামপ্রীতি যে মেসের অন্য সকলকে টেক্কা দিয়ে ডুবে ডুবে জল খাবে, ব্যাপারটা অন্য কারও সহ্য হয়নি । ইতিমধ্যে অবশ্য রমলাকে ইম্প্রেস করার যথাসাধ্য চেষ্টা কেদার (ভানু) করে ফেলেছিল এবং ব্যর্থও হয়েছে । কেদার সময়ে অসময়ে রমলাদের ঘরে পৌঁছে গিয়ে রমলার মা কে বলতঃ “মাসিমা, মালপোয়া খামু” । যদিও এসব করে লাভ কিছুই হয়নি । এত্তসব আক্রশে রামপ্রীতির জন্য বিচার চেয়ে চিঠিখানি মেস মালিক রজনী বাবুকে জমা করা হল। সেসময় রজনীবাবু বাড়ি ফেরার লাস্ট ট্রেন ধরতে ব্যস্ত-ত্রস্ত । কেদার চিঠিখানি রজনীবাবুর পকেটে গুঁজে দেন । 
- চিঠি নিয়ে আমি কি করব !
- আপনি কি করবেন মানে ? পুরো ব্যাপারটা আপনার জানা দরকার !
?
রজনীবাবু আশ্বাস দেন সপ্তাহ শেষে বাড়ি থেকে ফিরে এর বিচার করবেন । গল্পের প্রধান দ্বন্দ্ব এখানেই শুরু । মলিনা দেবীর হাতে সেই চিঠি পরে । তারপর ক্লাইম্যক্স । হ্যাপি এন্ডিং রামপ্রীতি ও রমলার বিয়ে দিয়ে ।  

সিনেমাটিতে তিনটি গান রয়েছে । মিউজিক করেছেন কালিপদ সেন । তবে প্রত্যেকের অভিনয় একেবারে নিখুঁত । সিনেমাটির পরিচালনা এবং স্ক্রিণ প্লে নির্মল দে-র।  কয়েকশোবার দেখার পরেও সিনেমাটির হাস্যরসের গুরুত্ব এতটুকুও কমেনি । শেষ কথা, এতগুলো তারকাকে আর কোনদিন একসাথে অভিনয় করেন নি, এবং এদের অনেকেই অভিনয় জগতেরই নন, সঙ্গীত জগতের।  



No comments: